Table Of Contents
এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক:
এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের অধিকার পাঁচটি: সালামের জবাব দেয়া, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, লাশের সাথে যাওয়া, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা, হাঁচির জবাব দেয়া।
বুখারী (১২৪০) ও মুসলিম (২১৬২) বর্ণনা করেন: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক পাঁচটি: ১) সালামের জবাব দেওয়া, ২) অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, ৩) লাশের অনুসরণ করা, ৪) নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা, ৫) হাঁচির জবাব দেওয়া।”
সহীহ মুসলিমে (২১৬২) বর্ণিত আছে: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক ছয়টি।” জিজ্ঞাসা করা হলো: হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? তিনি বললেন: “সাক্ষাৎ হলে তাকে সালাম দিবে। সে তোমাকে নিমন্ত্রণ করলে তুমি সাড়া দিবে। তোমার কাছে উপদেশ চাইলে তাকে উপদেশ দিবে। সে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়লে তুমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। সে অসুস্থ হলে তুমি তাকে দেখতে যাবে। সে মারা গেলে তুমি তার পিছে পিছে যাবে।”
শাওকানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
‘এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের 'হক' দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: যা ত্যাগ করা অনুচিত। যা পালন করা ওয়াজিব কিংবা এমন তাগিদপূর্ণ মুস্তাহাব যা ওয়াজিবের সদৃশ, যা ত্যাগ করা উচিত নয়। এখানে এই শব্দটি দ্বৈত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি এক শব্দ বিভিন্নার্থে ব্যবহৃত হওয়া শ্রেণীয়। কেননা ‘হক’ শব্দটি ওয়াজিব (আবশ্যক) অর্থে ব্যবহৃত হয় যেমনটি বলেছেন ইবনুল আ’রাবী। এছাড়াও শব্দটি সাব্যস্ত, অনিবার্য ও সত্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইবনু বাত্তাল বলেন: এখানে 'হক' দ্বারা উদ্দেশ্য সম্মান ও সাহচর্য।’[সমাপ্ত][নাইলুল আওত্বার (৪/২১)]
ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের বিবেচনা থেকে এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হকসমূহ:
এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের অধিকারগুলোর মধ্যে কোনটি ওয়াজিবে-আইন। তথা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সেটি পালন করা আবশ্যকীয়। যদি কেউ পালন না করে তাহলে সে গুনাহগার হবে। আর কোনটি ওয়াজিবে-কিফায়াহ। তথা কিছু মানুষ পালন করলে অন্যেরা আর গুনাহগার হবে না। আর কোনটি মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়। কোন মুসলিম সেটি পালন না করলে গুনাহগার হবে না।
১- যদি শুধু একজনকে সালাম দেয়া হয় তাহলে সালামের জবাব দেয়া তার উপর ওয়াজিব। আর যদি একদল মানুষকে সালাম দেওয়া হয় তাহলে সালামের জবাব দেয়া ফরযে-কিফায়াহ। আর শুরুতে সালাম দেওয়ার মূলবিধান সুন্নত।
আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাহ (১১/৩১৪) গ্রন্থে এসেছে: ‘সালাম দেওয়া সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা সালামের প্রসার কর।” একজনকে সালাম দেয়া হলে সালামের জবাব দেয়া তার উপর ওয়াজিব। আর একদল মানুষকে সালাম দেওয়া হলে তখন তাদের সবার উপর এর জবাব দেওয়া ফরযে-কিফায়াহ। অর্থাৎ যদি একজন জবাব দেয় বাকিদের উপর থেকে আবশ্যকতা মওকূফ হয়ে যাবে। আর যদি সবাই জবাব দেয় তাহলে সবাই ফরয আদায় করেছে বলে গণ্য হবে; চাই তারা এক সাথে জবাব দিক কিংবা একজনের পর অন্যজন জবাব দিক। আর যদি সবাই বিরত থাকে তাহলে তারা সবাই গুনাহগার হবে। কারণ হাদীসে আছে: এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক পাঁচটি: সালামের জবাব দেওয়া ...।’[সমাপ্ত]
২- অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া ফরযে-কিফায়াহ। শাইখ ইবনে উছাইমীন বলেন: ‘অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া ফরযে-কিফায়াহ’।[মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া-রাসাইল ইবনে উছাইমীন: (১৩/১০৮৫)]
৩- জানাযায় উপস্থিত হওয়াও ফরযে কিফায়াহ।
৪- আর নিমন্ত্রণে সাড়া দেয়া: যদি সেটা বিয়ের ওলীমার দাওয়াত হয় তাহলে অধিকাংশ মাযহাব মতে কোন শরয়ি ওজর ছাড়া সাড়া দেওয়া ওয়াজিব। আর যদি ওলীমা ছাড়া অন্য কোন উপলক্ষ্য হয় তাহলে অধিকাংশ মাযহাব মতে সাড়া দেওয়া মুস্তাহাব। তবে নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো বিস্তারিত জানতে দেখুন (22006) নং প্রশ্নের উত্তর।
৫- আর হাঁচির জবাব দেওয়ার হুকুম প্রসঙ্গে মতভেদ রয়েছে।
আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাহ (৪/২২) গ্রন্থে রয়েছে:
‘শাফেয়ীদের মতে হাঁচির জবাব দেওয়া সুন্নহ। হাম্বলীদের এক মতে এবং হানাফীদের মতে এটি ওয়াজিব। মালেকীদের মেত এবং হাম্বলীদের মাযহাবের মতে: হাঁচির জবাব দেওয়া ওয়াজিবে-কিফায়াহ। আল-বায়ান গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে: প্রসিদ্ধ মতানুসারে এটি ফরযে-আইন। কারণ হাদীসে আছে: যে মুসলিমই এটি (হাঁচির পরে আলহামদুলিল্লাহ) শুনতে পাবে তার জন্য ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা 'হক্ক' তথা আবশ্যকীয়।’[সমাপ্ত]
শক্তিশালী মত হলো: কেউ যদি হাঁচিদাতাকে আলহামদুলিল্লাহ পড়তে শুনে তার জন্য হাঁচির জবাব দেওয়া ওয়াজিব। কারণ বুখারী (৬২২৩) বর্ণনা করেন: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ হাঁচি পছন্দ করেন, আর হাই তোলা অপছন্দ করেন। কেউ যদি হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তাহলে এটি শুনতে পেয়েছে এমন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হাঁচির জবাব দেওয়া 'হক্ক' তথা আবশ্যকীয়।”
ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘ইতঃপূর্বে আবু হুরাইরার হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে যাতে রয়েছে: “তোমাদের কেউ যদি হাঁচি দেয় এবং আল্লাহর প্রশংসা করে তাহলে তা শুনতে পেয়েছে এমন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা 'হক্ক' তথা আবশ্যকীয়।”
তিরমিযী আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের পরিচ্ছেদের শিরোনাম দেন এভাবে: ‘হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ বলার জবাব প্রদানের আবশ্যকতা প্রসঙ্গে যা বর্ণিত হয়েছে সে সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ’। এই নামকরণ প্রমাণ করে যে হাঁচির জবাব দেয়া তার কাছে ওয়াজিব। এটাই সঠিক অভিমত। কারণ আবশ্যকতার পক্ষে সুস্পষ্ট হাদীসসমূহ রয়েছে, যেগুলোর বিপরীতে কোন হাদিস নেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
এ বিষয়ক হাদিসগুলোর মধ্যে রয়েছে: আবু হুরাইরার হাদীস, যা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও তাঁর থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস রয়েছে: "এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি হক ওয়াজিব।" সেগুলো ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরো রয়েছে সালেম ইবনে উবাইদের হাদীস, যেখানে আছে: ‘তার কাছে যে থাকবে সে যেন বলে: ইয়ারহামুকাল্লাহ’।
আরো রয়েছে: তিরমিযী কর্তৃক সংকলিত আলী (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের ছয়টি সদ্ব্যবহারের বিষয় আছে: (১) তার সাথে দেখা হলে তাকে সালাম করবে, (২) নিমন্ত্রণ করলে তাতে সাড়া দিবে, (৩) সে হাঁচি দিলে উত্তর দিবে (তার আলহামদুলিল্লাহর উত্তরে বলবে ইয়ারহামুকাল্লাহ), (৪) সে রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাবে, (৫) সে মারা গেলে তার লাশের অনুসরণ করবে এবং (৬) নিজের জন্য যা ভালোবাসে তার জন্যেও সেটাকে ভালোবাসবে।” তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান। একাধিক সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ এ হাদিসের এক বর্ণনাকারী আল-হারেস আল-আ’ওয়ার এর সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবু আইয়ুব (রাঃ), আল-বারা (রাঃ) এবং আবু মাসউদ (রাঃ) থেকেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আরো রয়েছে: তিরমিযী কর্তৃক সংকলিত আবু আইয়ুব (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ যখন হাঁচি দিবে তখন সে যেন বলে: আলহামদুলিল্লাহ। এর সাথে যেন বলে: ‘আলা কুল্লি হাল’। যে ব্যক্তি তার জবাব দিবে সে যেন বলে: ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’। আবার হাঁচিদাতা যেন বলে: ‘ইয়াহদীকুমুল্লাহু ওয়া ইউসলিহু বালাকুম’।”
এ হাদিসগুলোর মধ্যে হাঁচির জবাব দেয়া ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে চার ধরনের প্রমাণ রয়েছে: এক: হাঁচির জবাব দেওয়ার আবশ্যকতা দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট শব্দে তথা 'ওয়াজিব' শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করা; যা কোনো ধরনের ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। দুই: 'হক' শব্দ ব্যবহার করার মাধ্যমে আবশ্যক করা। তিন: على অব্যয়টির প্রত্যক্ষ অর্থ 'ওয়াজিব' আরোপ করা। চার: নির্দেশ প্রদান। এই ধরনগুলো ছাড়া অন্যভাবেও বহু ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।’[সমাপ্ত][হাশিয়াতু ইবনুল কাইয়্যিম ‘আলা সুনানি আবি দাউদ (১৩/২৫৯)]
তিনি আরো বলেন: ‘প্রথম হাদীসটির প্রত্যক্ষ মর্ম: যে ব্যক্তিই হাঁচিদাতাকে 'আলহামদু লিল্লাহ' বলতে শুনবে তার জন্য এর জবাব দেওয়া ফরযে-আইন (ব্যক্তিক ফরয)। তাই সবার পক্ষ থেকে একজনে হাঁচির জবাব দেওয়া যথেষ্ট হবে না। এটি আলেমদের দুটো অভিমতের একটি। মালেকী আলেম আবু যাইদ ও আবু বকর ইবনুল আরাবী এটি বাছাই করেছেন। এই মতকে প্রতিহতকারী কিছু নেই।’[সমাপ্ত][যাদুল মা’আদ (২/৪৩৭)]
৬- তার কাছে উপদেশ চাইলে সে উপদেশ দিবে। উপদেশ দেয়ার হুকুমের ক্ষেত্রে শক্তিশালী মত হলো এটি ওয়াজিবে কিফায়াহ।
ইবনু মুফলিহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘ইমাম আহমদ ও তাঁর সাথীদের কথার প্রত্যক্ষ মর্ম হলো: কোন মুসলিমকে সু-পরামর্শ দেওয়া আবশ্যক, যদিও সে নিজের থেকে পরামর্শ না চায়; যেমনটি হাদীসের প্রত্যক্ষ মর্ম থেকে বোধগম্য ...’ [সমাপ্ত][ইবনু মুফলিহ রচিত ‘আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ’ (১/৩০৭)]
মোল্লা আলী ক্বারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ ‘অর্থাৎ সে যদি তোমার কাছে উপদেশ চায় তাহলে তুমি উপদেশ দিবে। তথা আবশ্যকীয় বিশ্বাস করে দিবে। অনুরূপভাবে সে উপদেশ না চাইলেও তাকে উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’[সমাপ্ত][মিরক্বাতুল মাফাতীহ (৫/২১৩)]
হাফিয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে এখানে 'হক' দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ওয়াজিব হওয়া। এটি ইবনু বাত্তালের বক্তব্যের বিপরীত, যিনি বলেছেন সম্মান ও সাহচর্যের অধিকার। প্রত্যক্ষ অর্থ হলো: এখানে 'হক' দ্বারা ওয়াজিবে-কিফায়াহ উদ্দেশ্য।’[সমাপ্ত][ফাতহুল বারী (৩/১১৩)]
আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ।